নকল মানব (Sci-fi)

 নকল মানব


নিশুতি রাত।

চতুর্দিক গাঢ় অন্ধকারে ছেয়ে গেছে। ঝোপের ভেতর কিছু জোনাকি দলবেঁধে মিটিমিটি করে স্নিগ্ধ আলো জ্বালাচ্ছে। কাঁচা রাস্তা। বিকেলে এক পশলা বৃষ্টি হওয়ায় পথঘাট কাদায় টইটম্বুর। পা পিছলে পড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা ব্যাপক। রাত দুটা বাজে এখন। বাঁশবনের শোঁ শোঁ আওয়াজ ভয় ধরিয়ে দিচ্ছে মনের ভেতর। এই ভয় আসলে টাকা হারানোর ভয়। শফিকের এমনটা আগে কখনও হয়নি। চার বছর ধরে সে কামারিয়া চৌরাস্তা বাজারে মুদিরদোকান চালাচ্ছে। এত রাত করে সে কোনওদিনই বাড়ি ফিরেনি। সর্বোচ্চ রাত এগারোটা কি বারোটা পর্যন্ত সে দোকান খোলা রাখে। বাড়ি ফেরার পথে সচরাচর এক-দুইজনকে পাওয়া যায়। কিন্তু আজ সে একা। কোনও জনমানবের চিহ্ন বা আনাগোনা নেই রাস্তায়। সাথে চল্লিশ হাজার টাকা। এতগুলো টাকা নিয়ে যেতে ভয় করছে তার। পথে কোনও অঘটন না ঘটে যায়। সবাই জানে আজ জাঁকজমকভাবে শফিকের দোকানে হালখাতা হয়েছে। বাজারের অসৎ লোকগুলো যদি কোনও ছোটোখাটো অস্ত্র নিয়ে ওঁৎ পেতে থাকে? ভাবতেই সমস্ত শরীর তিরতির করে কেঁপে ওঠে শফিকের। ছোটোবেলা থেকেই সে অনেক ভীতু। আজকে মনের ভেতর টাকা হারানোর গভীর ভয় থাকায়, ভূত-প্রেতের ভয়টা নস্যি। একবারের জন্যও মনে উদয় হলো না যে, এত রাতে শ্মশানঘাটে কী হতে পারে।


কামারিয়া গ্রামের দক্ষিণ পাশ দিয়ে প্রবাহিত খুব ছোটো নদীটিতে এখন পানি থৈ থৈ করছে। বর্ষাকালে যা একটু পানি হয়, আর সারা বছর পানির দেখা পাওয়া যায় না। গোরু-ছাগল অনায়াসে পার হয়ে যায়। পুরো নদীটাকে তখন মনে হয় একটা বিশাল বড়ো খোলা মাঠ। ছেলেরা মহাসুখে সেখানে ফুটবল খেলে। এই নদীরই একপাশে হিন্দুদের শ্মশান। গ্রামের মানুষদের কাছে শ্মশান এক ভয়ঙ্কর ব্যাপার। দিনেরবেলা এতটা ভয় না করলেও, রাতে কিন্তু সবচেয়ে সাহসী লোকটাও কাছ দিয়ে গেলে গা ছমছম করে। এই বুঝি কোনও অশুভ হাওয়া শরীরে লাগল। তাছাড়া লোকমুখে প্রচলিত অনেক অদ্ভুত গল্পও ছড়িয়ে আছে এই শ্মশানঘাটকে ঘিরে। নদীর এই ঘাট দিয়ে কেউ মাছ ধরতে যায় না, শখের বশে বা মাছ ধরার উদ্দেশ্যে এখান দিয়ে কেউ কলাগাছের ভেলা ভাসায় না, ভুলেও গোসল করতে কেউ নামে না এই ঘাট দিয়ে। এককথায় এই ঘাটটা অবহেলিত বা পরিত্যক্ত হয়ে পড়ে আছে। হিন্দু পরিবারের কেউ মারা গেলে এই ঘাটে এনে সৎকার করা হয়। তাই শ্মশানঘাট নামেই পরিচিত এই জায়গাটা। শ্মশানের সাথেই একটা সরু রাস্তা। রাস্তাটাই মূলত নদীর একটা পাড়। এই রাস্তা দিয়েই গ্রামের মানুষ চলাচল করে। রাস্তার সাথে শ্মশান থাকায় রাতেরবেলা এদিকটায় মানুষের আনাগোনা কিছুটা কম। রাতে ছোটো বাচ্চারা যখন কাঁদে, মায়েরা তখন ভয় দেখায়। 'এই যে শ্মশানঘাট থাইক্যা ভূত আসতাছে। কালা কালা ভূত। কান্নাকাটি বন্ধ না করলে আইসা ধরবো।' ব্যস, এতেই কাজ হয়। সাথে সাথেই কান্না বন্ধ।
শফিককে বাড়ি যেতে হলে শ্মশানঘাট অতিক্রম করতেই হবে। আর কোন‌ও‌ বিকল্প রাস্তা নেই। সে টর্চলাইট জ্বেলে খুব সন্তর্পণে হাঁটছে। শ্মশানঘাটটা খুব বেশি দূরে নয়। টর্চলাইটের আলোটা একটু দূরে ফেললেই দেখতে পারার কথা। কিন্তু মনের ভেতর তো শুধু টাকার চিন্তা। তাই শ্মশানঘাটটা চোখে পড়ছে না। আজ অনেক পরিশ্রম হয়েছে। সেই সকাল থেকে কাজে লেগেছিল। দোকান সাজানো, এলাকার কিছু গণ্যমান্য ব্যক্তিকে দাওয়াত করা, অনেক লেখালিখির হিসাব আর‌ও কত কী। তাছাড়া কর্মচারী হিসেবে যে ছেলেটা এতদিন ছিল সে তিনদিন আগে চলে গিয়েছে কী একটা অজুহাত দেখিয়ে। এখন তাই শফিককেই একা যাবতীয় কাজকর্ম করতে হয়।
রাস্তার পাশে থাকা এক বিশাল বড়ো গাছ থেকে আচমকা একটা মাঝারি ধরনের ডাল ভেঙে পড়ল। ঝড়বৃষ্টি কিছু নেই, অথচ ডাল ভেঙে পড়ল কেন? তা-ও আবার শফিকের ঠিক সামনে। এই প্রথম তার মনে অন্যকিছু ভাবনা উদয় হলো। টর্চলাইটটা সে গাছের উপরে তাক করে ধরল। কিন্তু তেমন কিছু চোখে পড়েনি। সুনিপুণভাবে চারপাশে টর্চলাইটের আলো ফেলে একনজর সে সবকিছু দেখল। নাহ্, তেমন সন্দেহজনক কিছু নেই। আরেকটু দূরে আলো ফেলল সে। আর তখনই সারা শরীর কেঁপে উঠতে শুরু করল তার। 'হায় হায়! এতক্ষণ তো খেয়াল করলাম না। এখন?' অস্পষ্টভাবে বিড়বিড় করে বলল সে। এখান থেকে খুব স্পষ্ট‌ই দেখা যাচ্ছে শ্মশানঘাটটা। ভয়ার্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে কিছুক্ষণ ভাবল সে- এই ভয়ঙ্কর জায়গাটা কীভাবে পার হ‌ওয়া যায়? কিন্তু কোন‌ও বুদ্ধিই তার মাথায় খেলছে না। আবার কি ফিরে যাবে দোকানে? আজকের রাতটা দোকানে কাটিয়ে দিলে কেমন হয়? নানা ভাবনা লুকোচুরি খেলছে মাথায়। কিন্তু কোন‌ওভাবেই শ্মশানটা একা পার হ‌ওয়া যাবে না। এটা নিশ্চিত করে ভেবে ফেলে সে।
শফিক দোকানের উদ্দেশে পা বাড়াল। পা যেন এখন চলছেই না, যদিও একটু আগে সে অনবরত হাঁটছিল। শ্মশানঘাট-ভাবনাটা আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরেছে সর্বাঙ্গে। কত শত গল্প মনে পড়ছে এখন। এইতো দুদিন আগে মঞ্জু মেম্বার তার দোকানে বসে একশো পার্সেন্ট টাটকা একটা ঘটনা বলেছে। ঘটনাটা ঠিক এরকম- মঞ্জু মেম্বার একদিন অনেক রাত করে তার মেয়ের বাড়ি থেকে ফিরছিল। শ্মশানঘাটে এসে যখন পৌঁছে, তখন রাত একটা বাজে। দুরুদুরু বুক নিয়ে শ্মশানঘাট পার হচ্ছিল। রাস্তার একদম পাশেই শ্মশান। চেষ্টা করছিল কোন‌ও মতেই যাতে ওদিকে চোখ না যায়। কিন্তু মঞ্জু মেম্বার তা পারেনি। নিজের অজান্তেই তাকে ফাঁকি দিয়ে তার চোখ চলে যায় শ্মশানে। শ্মশানে ঘুটঘুটে অন্ধকার। নানা আগাছা ও গাছগাছড়া ছড়িয়ে আছে এলোপাতাড়িভাবে। মঞ্জু মেম্বারের কাছে টর্চলাইট ছিল না। চাঁ‌‌‌‌দ নির্ভর আলোয় পা চালাচ্ছিল সে। শ্মশানের দিকে চোখ পড়তেই দেখে কে যেন বসে আছে উদাস মনে। গাঢ় অন্ধকারে কিছু দেখার কথা নয়, কিন্তু লোকটাকে দেখা যাচ্ছে। ভারি অদ্ভুত! বুকের ভেতর একরাশ ভয় নিয়ে একটু এগোয় সে। সে লোকটার মুখটা স্পষ্টভাবে দেখে ভ্যাবাচ্যাকা খায়। হায় হায়! এ কী করে সম্ভব? অবিকল নিজের চেহারার মতোই একজন বসে আছে শ্মশানে। সে যেন আয়নায় নিজের প্রতিবিম্ব দেখছে। শ্মশানের লোকটা মাথা তুলে তার দিকে তাকায়। ক্ষণিকের জন্য হেসে দেয় লোকটা। অন্ধকারে এই হাসিটাও স্পষ্ট দেখা যায়। এই হাসি দেওয়া হয় পরিচিত কাউকে অনেকদিন পর দেখলে। ভীষণ ঘাবড়ে যায় মঞ্জু মেম্বার। এদিকে তার মতোই দেখতে লোকটা গুটিগুটি পায়ে এগিয়ে আসে বিড়ালের মতো নিঃশব্দে। মঞ্জু মেম্বারের শরীর ঘামতে থাকে, সাথে গরম ভাপ বের হয়। হাত-পা অবশ হয়ে যায় যেন। কাছে এসে দুহাত দিয়ে গলা চেপে ধরে লোকটা। মঞ্জু মেম্বারের জান বেরিয়ে যাওয়ার জোগাড়। গলা ছেড়ে চিৎকার দিতে পারছিল না প্রচণ্ড ভয়ে। তারপরও অনেক ধস্তাধস্তি হয় দুজনের মধ্যে। মঞ্জু মেম্বার যখন লোকটার দিকে তাকায়, তখন সে ভয়ে শিউরে ওঠে। এ যেন নিজের সাথেই লড়াই করছে সে। সে কীসের খপ্পরে পড়ে যায় তা বুঝতে বাকি থাকেনি। মঞ্জু মেম্বারের গায়ে বেশ জোর। সে এত সহজে ছাড়ার পাত্র নয়। পাঁচ মিনিট ধস্তাধস্তি হয় তাদের মধ্যে। একপর্যায়ে সারা গায়ে ক্লান্তি নেমে আসে মঞ্জু মেম্বারের। সে অনুভব করে তার শক্তি হ্রাস পাচ্ছে। হাল ছেড়ে দেয় সে। শ্মশানের লোকটা তখন বুকের উপর উঠে বসে তার। পাঁচ ছয় মণ ওজনের কোন‌ও মাল যেন লোকটা। বুক ও পেট মাটির সাথে লেপ্টে যাবে যাবে ভাব। লোকটা তার ডান হাতটা বাড়িয়ে দেয় মঞ্জু মেম্বারের চোখের উপর। 'চোখ খুলে খেয়ে ফেলবে নাকি?' অসহায় মঞ্জু মেম্বার মনে মনে ভাবে। জীবনের মায়া সে প্রায় ছেড়েই দিচ্ছিল। তখনি রাস্তায় আলো জ্বলে উঠল। এত রাতে আলো নিয়ে আবার কে এল? মঞ্জু মেম্বারের মনে আশার আলো আপতিত হয়। দশ হাত দূরে দেখে হরিচরণ মাঝি দাঁড়িয়ে আছে। তার হাতে একটা বড়ো হারিকেন। একনজর হারিকেনের দিকে তাকিয়েই শ্মশানের দিকে ঝোপঝাড় নাড়িয়ে দৌড় দেয় লোকটা যে মঞ্জু মেম্বারের রূপ ধরে এসেছিল। মঞ্জু মেম্বার উঠে দাঁড়ায়। তার নাকের নিচে স্বস্তির নিঃশ্বাস। হরিচরণ ও মঞ্জু মেম্বার দুজনেই দেখে সেই চোখের পলকের দৌড়। তারপর‌ অন্ধকারে নিমিষেই মিলিয়ে যায় লোকটা। হরিচরণ বলে, 'রাইতের বেলা তেনারা আনাগোনা করে। এই সময় আগুন ল‌‌ইয়া বাইর হ‌ইতে হয়। লাইটের আগুনে কা‌ম হয় না, আসল আগুন দেখলেই তেনারা শুধু ডরায়।'
শফিক দোকানে ফিরে এল। মঞ্জু মেম্বারের পুরো ঘটনাটা মনে পড়ল তার। সত্য-মিথ্যা সে জানে না। কিন্তু আজকের রাতটা যে দোকানে কাটাতে হবে এতে কোন‌ও ভুল নেই। শফিক মেঝেতে দোকানের হাবিজাবি বিছিয়ে বিছানা পেতে শুয়ে পড়ল। বাজারে কোন‌ও মানুষ নেই। কোন‌‌‌ও কুকুর বিড়াল‌ও হয়তো এখন জেগে নেই। চারদিকে সুনসান নীরবতা। দোকান থেকে সামান্য দূরে একটা বটগাছ। সেই বটগাছের পাতার শোঁ শোঁ আওয়াজ কানে আসছে। আকাশের অবস্থা‌ও ভালো নয়। মনে হয় ঝড়বৃষ্টি হতে পারে। এসব ভাবতে ভাবতে কখন যে শফিকের দুচোখের পাতা পুরোপুরি লেগে গেছে তা সে নিজেও জানে না।
পরদিন সকালবেলা। শফিক বাড়ি ফিরে টাকাগুলো ব‌উয়ের হাতে দিল। তার ছোটো মেয়েটা বলল, 'বাবা, তুমি কালকে রাতে যখন বাড়ি ফিরলে, আমি তখন জেগে ছিলাম। তুমি রাগী রাগী গলায় মাকে বললে- আজ রাত ঘরে থাকব না, দোকানে থাকব। দোকানে ম্যালা কাজ। কিন্তু তুমি কী কাজ করলে, বাবা?'
শফিক আকাশ থেকে পড়ল। কী বলছে তার মেয়ে! সে তো গতরাতে বাড়িই ফিরেনি। তাহলে কে এসেছিল বাড়িতে? কিছুক্ষণ ভেবে সে বলল, 'আমি তো রাতে দোকানে ছিলাম, বাড়িতে আসিনি।'
ছোটো মেয়েটা হেসে হেসে বলল, 'কী বলছ তুমি এইসব? তুমি তো বারান্দায় বসেছিলে কিছুক্ষণ। তারপর যখনি কারেন্ট চলে যায়, মা তখন মোমবাতি জ্বালায়। আর তখনি তুমি দৌড়ে চলে গেলে।'
শফিকের মাথায় বজ্রপাত বর্ষণ হলো যেন। তার বুঝতে আর অসুবিধা হয়নি যে, গতরাতে কে এসেছিল বাড়িতে। সে ভারি দুশ্চিন্তায় পড়ে গেল। প্রতিজ্ঞা করল আর কোন‌ওদিন‌ই দেরি করে বাড়ি ফিরবে না। হরিচরণ মাঝি তাহলে মঞ্জু মেম্বারকে সত্য কথাই বলেছিল। আগুন দেখলে এরা খুব ভয় পায়।
ছোটো মেয়েটা আবার বলল, 'বাবা, তুমি কী ভাবছ? মনে হয় রাতে তোমার ভালো ঘুম হয়নি।'
বুকে ভয় চেপে শফিক সেরকম‌ই একটা ভাব দেখিয়ে বলল, 'ঠিক বলেছিস। তারপর রাতে আমি আর কী কী করেছিলাম? বলতো শুনি।'
তার ছোটো মেয়েটা আবার ফিকফিক করে হেসে বলল, 'তুমি মাকে বললে যে, তোমার খুব ক্ষুধা লেগেছে। মা তাই খুব তড়িঘড়ি করে ভাত বাড়ল। তুমি ঘরে না ঢুকে বারান্দায় টুলে বসে খেলে‌। কিন্তু আশ্চর্যের ব্যাপার হচ্ছে তুমি ভাতগুলো খেলে না। শুধু মাছের টুকরোটা খেলে গাপুসগুপু‌স করে। আর তখনি কারেন্ট চলে গেল। মা মোমবাতি জ্বালিয়ে আনে। আর তুমি চলে গেলে সঙ্গে সঙ্গেই। মা এত করে ডাকল, কিন্তু তুমি পেছনেই থাকালে না। আচ্ছা বাবা, কী হয়েছিল তখন?'
শফিক কী বলবে ভেবে পাচ্ছে না। উত্তেজনায় তার শরীর কাঁপছে। এ কী করে সম্ভব? বুদ্ধি খাটিয়ে সে বলল, 'তখন দোকানের একটা বাকির হিসাব চট করে মনে পড়েছিল। তাই দিলাম এক দৌড়। পরে যদি আবার ভুলে যাই! হে হে হে।' শফিক একটা মৃদু হাসি দিলেও প্রচণ্ড দুশ্চিন্তা জড়িয়ে ধরেছে তার মাথায়। শ্মশান সম্পর্কে সে এতদিন যা শুনে এসেছে, আজ তা বাস্তবে রূপ নিল। ভয়ানক রকম ভয় পেয়ে গেল সে। পুরো শরীর ঘেমে-নেয়ে একাকার। জ্বর উঠে যাচ্ছে কি-না সে বুঝতে পারছে না।
দুদিন পর। এখন‌ও সেই ভয়টা কাটেনি। সকাল সাতটা। শফিক বাজারে এসে দোকান খুলেছে। এত সকালে সে সচরাচর দোকান খুলে না। আজ তার ব্যতিক্রম ঘটল। এখনও অবশ্য কোনও কাস্টমার আসেনি। সে দোকান ঝাড়ু দিল। ধুলোবালি যাতে দোকানে না ঢুকতে পারে সেজন্য রাস্তায় ছোটো একটা বালতি দিয়ে পানি ছিঁটাল। তার দোকানের সামনে দিয়ে হেঁটে ছোটো ছোটো ছেলেমেয়ে মক্তবে যাচ্ছে।
শফিক দোকানের গদিতে এসে বসল। আর তখনি নাক-মুখ কাপড়ে ঢেকে একজন দোকানের সামনে এসে দাঁড়াল। লোকটাকে চেনা যাচ্ছে না। শফিক বলল, 'আপনি কে? মুখ ঢেকে রেখেছেন কেন?'
লোকটা খুব আস্তে করে বলল, 'তার আগে বলুন তো আশেপাশে কেউ আছে কি-না?' শফিক খুব‌ই বিস্মিত হলো, 'না, কেউ নেই এদিকে। আজব তো। আপনি কে, ভাই?'
'আমি হচ্ছি আপনি।'
'মানে কী?'
'মানে আমিই আপনি। এই যে দেখুন।' কথাটা বলেই লোকটা তার মুখ থেকে কাপড়টা সরিয়ে নিল। এখন তাকে খুব ভালোভাবেই দেখা যাচ্ছে। শফিক ভীষণ ভ্যাবাচ্যাকা খেল। কী দেখছে সে এটা? হুবহু তার মতোই দেখতে একজন লোক দাঁড়িয়ে আছে তার সামনে। ঠিক যেন তার জমজ ভাই। চোখের আকৃতি বড়ো করে তাকিয়ে আছে শফিক। লোকটা তখন মুখ খুলল, 'আমি তো বলেছি আমি হচ্ছি আপনি। আপনাকে কপি করা হয়েছে। যেটাকে আমরা বলে থাকি হিউম্যান-কপি অর্থাৎ মানব প্রতিলিপি।'
শফিক বলল, 'ভাই, আপনি এইসব কী বলছেন? আমার মাথায় তো কিছু ঢুকছে না।'
লোকটা বলল, 'আমি এসেছি অনেক দূর থেকে। সূর্যের সবচেয়ে দূরবর্তী গ্রহ নেপচুন থেকে। সেখানকার প্রাণীদের নিয়ে হিউম্যান‌রা তেমন মাথা ঘামায় না। কিন্তু আমরা হিউম্যানদের নিয়ে প্রচুর গবেষণা করি। তেমনি একটা হচ্ছে হিউম্যান-কপি। এটা নিয়ে অনেকদিন ধরেই গবেষণা চলছিল আমাদের গ্রহে।'
'আমি গতরাতে কিছু না খেয়ে শুয়ে পড়েছিলাম, সকালেও কিছু খাইনি। তাই বোধহয় আজেবাজে জিনিস দেখছি। মাথার নাট বল্টু মনে হয় লুজ হয়ে গেছে। ভাই, আপনি যান তো। আমি খেয়ে আসি।'
লোকটা বলল, 'না, আপনি ঠিক আছেন এবং খুব সুস্থ আছেন। এই দেখুন আমি আপনার মতোই দেখতে। আপনার ভাষাতেই কথা বলছি। দুদিন আগে আমি আপনার বাড়িতে গিয়েছিলাম।'
এই কথাটা শুনেই শফিকের সবকিছু মনে পড়ে গেল। সে আর‌ও ভালো করে লোকটার দিকে তাকাল। নাহ্, কোনও ভুল নেই। লোকটা যেন তার‌ই জমজ ভাই। তার মনে উঁকি দিল শ্মশানের ভূতের কথা। মঞ্জু মেম্বারের কথা। তার ছোটো মেয়েও এরকম একটা গল্প বলেছিল। শফিক কোন‌ও কথা বলছে না। বোকার মতো হাঁ করে তাকিয়ে আছে। ভূত-প্রেতগুলো আজকাল মনে হয় দিনেও আনাগোনা করে। কী আজব ব্যাপার!
লোকটা আবার বলল, 'আপনি মনে মনে যা ভাবছেন, আমিও তা-ই ভাবছি। এই বিজ্ঞানের রাজত্বে ভূত-প্রেত নিয়ে আমাদের কোন‌ও গবেষণা নেই।'
শফিক অবাক হয়ে খুব আগ্রহ নিয়ে বলল, 'আপনি কি আসলেই ভিনগ্রহী? আমার তো খটকা লাগছে। আবার মোটামুটি বিশ্বাস‌ও হচ্ছে।'
'অবিশ্বাসের কিছু নেই। এই মহাবিশ্বটা হচ্ছে আসলে বিশ্বাসের মারপ্যাঁচ। আপনি এখানে অবিশ্বাস করলেই ঠকবেন।'
শফিক বোকা কিসিমের মানুষ। অন্যের সামান্য কথাতেই সে গলে যায়। যেকোন‌ও বিষয় তার মাথায় চট করে ঢুকে পড়ে। এই বিষয়টাও বুঝতে বেশি সময় লাগল না। তাছাড়া একমাস আগে তার দোকানে ভিনগ্রহ এবং ভিনগ্রহীদের নিয়ে একটা আলোচনা হয়েছিল। সে যে এখন আসলেই একটা ভিনগ্রহীর খপ্পরে পড়ে গেছে এটা সহজেই মেনে নিল। লোকটা তার সাজ ধরে এসেছে বিধায় তার খুব গর্ব হচ্ছে। লোকটার দিকে তাকালেই কেমন মায়া হয়। শফিক নিজেকেই যেন সে দেখছে। জীবনে আগে কখন‌ও এমন বিস্মিত হয়েছে বলে মনে হয় না। সে দোকান থেকে গুটিগুটি পায়ে বেরিয়ে এল। লোকটার কাছে গিয়ে বলল, 'আমি গরিব মানুষের কাতারে পড়ি। আপনি আমার সাজ ধরে আমার কাছে কেন আসছেন? আর কী যেন বললেন...ও হ্যাঁ, মনে পড়েছে...নেপচুন। ওখান থেকে কীভাবে এলেন? কেন এলেন?'
লোকটা স্বাভাবিক গলায় বলল, 'এসেছি স্পেসশিপে করে। আজ রাত একটায় সেই স্পেসশিপ আবার আসবে।'
'স্পেসশিপ?'
'হ্যাঁ, আপনি কি দেখতে চান আমাদের স্পেসশিপটা?'
'আসমান দিয়ে কত বিমান উড়ে যায়। আমার শখ খুব কাছে থেকে যদি দেখতে পেতাম ওগুলো।'
'ঠিক আছে, আজকে আপনাকে আমাদের স্পেসশিপে চড়াব।'
'কী বলছেন? সত্যিই?' শফিকের চোখে রাজ্যের বিস্ময়।
'হ্যাঁ, কিন্তু খবরদার কাউকে কিছু বলতে পারবেন না। জীবনে চলার পথে গোপনীয়তার দরকার আছে।'
'আমার স্ত্রীকেও বলতে পারব না?'
'উঁহু, কার‌ও সাথে কিছু বলা যাবে না।'
'কাউকে কিছু বলতে পারব না কেন?'
'আপনি যদি কাউকে বলেন যে, আপনি একজন ভিনগ্রহীর সাথে কথা বলেছেন। তাদের স্পেসশিপে চড়েছেন। তাহলে নানান ঝামেলা হবে। কেউ বিশ্বাস করবে না। তাই বলছি বলার দরকার নেই।'
'আচ্ছা, ঠিক আছে।'
'আপনি রাত একটার সময় নদীর পূর্বপাশের ঘাটটায় আসবেন। আমি আপনার জন্য অপেক্ষা করব।'
'এত রাতে?'
'হুমম, তখন তো মানুষরা জেগে থাকে না, এজন্যই। আমি এখন যাই। মানুষজন দেখে ফেললে আবার সমস্যা হবে।'
'তা আপনার নামটা কী?'
'বললাম তো আমি মানেই আপনি। আপনার নাম শফিক, তাই আমার নাম‌ও শফিক। আপনাকে কপি করার পর থেকেই এই নাম। তবে নেপচুন গ্রহে আমার নাম হচ্ছে ঙুঙু। এখন এটা বাদ অবশ্য। আমিও শফিক। আপনিও শফিক।'
'কিন্তু আপনি আমাকে কপি করলেন কেন? নেপচুন ছেড়ে এই দূষিত পৃথিবীতে এলেন কোন কারণে?'
লোকটা ব্যস্ততা দেখিয়ে বলল, 'এটা আপনি পরে বুঝতে পারবেন। এখন যাই।'
'একটু দাঁড়ান। সেদিন আমার স্ত্রী যখন মোমবাতি জ্বালাল, তখন আলো দেখে আপনি চলে গেলেন কেন?'
'আলো আমাদের অসহ্য লাগে। তবে এখন আর অসহ্য লাগে না। নতুন একটা প্রোগ্রাম সেট করা হয়েছে চোখে। এখন অভ্যস্ত হয়ে গেছি। আচ্ছা, যাই আমি। রাতে কিন্তু দেখা হচ্ছে। মনে থাকে যেন- রাত একটা।'
লোকটা কাপড় দিয়ে আবার মুখ ঢেকে চলে যাচ্ছে। শফিক খুব আগ্রহ নিয়ে তাকিয়ে আছে সেদিকে। একসময় লোকটা মূল রাস্তা ধরে হাঁটতে হাঁটতে দৃষ্টিসীমার বাইরে চলে গেল। শফিক তখন‌ও তাকিয়েই র‌‌ইল।
রাত একটা দশ। শফিক কাউকে কিছু না জানিয়ে নদীর পূর্বপাশের ঘাটটায় গিয়ে দেখে একটা ছোটোখাটো স্পেসশিপ দাঁড়িয়ে আছে। ঠিক একটা বাসের মতোই হবে আকারে। সে ভেবেছিল স্পেসশিপ বোধহয় আর‌ও বড়ো হবে। আর‌ও জাঁকজমকপূর্ণ হবে। তারপর সে দেখল তার মতোই দেখতে লোকটা দরজা খুলে ভেতর থেকে বেরিয়ে আসছে। লোকটা বলল, 'আপনি ভাবছেন স্পেসশিপটা ছোটো, তাই না?'
আসল শফিক বলল, 'হ্যাঁ, কিন্তু আপনি জানলেন কী করে?'
'আমি তো বলেছি আগেই- আমি মানে আপনি। এখন তাড়াতাড়ি স্পেসশিপে উঠে পড়ুন তো।'
শফিক সাত-পাঁচ না ভেবেই স্পেসশিপে উঠে পড়ল। আলাদা একটা কক্ষে তাকে নিয়ে যাওয়া হলো। তার ভীষণ আনন্দ লাগছে। একেবারে আহ্লাদে আটখানা যাকে বলে। লোকটা নেমে পড়ল স্পেসশিপ থেকে। তারপর বাইরে এসে রিমোট টিপে দিল। আর সাথে সাথেই সাঁই করে উড়ে চলল স্পেসশিপটা। লোকটার মুখে দানবীয় হাসি। এটা একমাস পর নেপচুন গ্রহে ল্যান্ড করবে।
আর এদিকে লোকটা (নকল শফিক) হেঁটে চলল শফিকের বাড়ির দিকে। তাকে এখন আজীবন শফিকের ভূমিকায় জীবন কাটাতে হবে। নেপচুন গ্রহবাসীরা ‌মূলত এটাই চায়। মানুষের জীবন তাদেরকে প্রবলভাবে আকৃষ্ট করেছে। এ পর্যন্ত এক লাখ নব্বই হাজার মানুষকে তারা কপি করেছে। সেই কপি করা মানুষের ভেতর নিজেদের প্রাণ সঞ্চালন করছে। আর আসল মানুষটাকে বিভিন্ন প্রলোভন দেখিয়ে একান্ত গোপনে পাঠিয়ে দিচ্ছে নেপচুন গ্রহে। দিন দিন বাড়ছে সেই সংখ্যা। এদিকে পৃথিবীবাসীর এ ব্যাপারে কোন‌ও জ্ঞান‌ই নেই। নকল মানুষে ভরে যাচ্ছে পৃথিবী।


লিখেছেন,
আনন্দ মোহন কলেজ,ময়মনসিংহ



No comments

Theme images by dino4. Powered by Blogger.