একজন এডমন্ড হ্যালী

একজন এডমন্ড হ্যালী

 

হ্যালীর ধুমকেতু নামটা শুনলেই মনে হয় একটা বৈজ্ঞানিক ব্যাপার। হ্যালীর ধূমকেতু নামটা এসেছে এডমন্ড হ্যালীর নামনুসারে। এডমন্ড হ্যালী ধুমকেতু নিয়ে প্রথম পর্যবেক্ষেণ করেন।

এডমন্ড হ্যালী জন্মেছিলেন ৮ ই নভেম্বর, ১৬৫৬ খ্রিস্টাব্দে লন্ডনের কাছাকাছি শোরেডিচ এর হ্যাগারস্টোন শহরতলিতে। তার বাবার নামও ছিল এডমন্ড হ্যালী। বাবা ছিলেন সাবান কারখানার মালিক। তিনি ছিলেন Derbyshire  পরিবারের অন্তর্গত এবং ধনবান। জুলিয়ান ক্যালেন্ডার অনুসারে হ্যালির জন্মদিন ২৯ অক্টোবর, ১৬৫৬ ধ্রিস্টাব্দ।৷ এডমন্ড হ্যালী ১৭৪২ ধ্রিস্টাব্দের ১৪ ই জানুয়ারী মারা যান লন্ডনের সন্নিকটস্ত প্রীনউইচ শহরে।

এবছর বয়সে ১৬৭৩ সালে তিনি ভর্তি হন অক্রফোর্ডের কুইন্স কলেজে। এখানে ভর্তি হওয়ার সময়ই জ্যোতির্বিজ্ঞানের অনেক কিছু তিনি শিখে ফেলেছিলেন। অর্থাৎ কলেজের ছাত্র হওয়ার সময় তিনি ছিলেন দক্ষ জ্যোতিরিজ্ঞানী। ১৬৭৫ সালেই তিনি রাজকীয় জ্যোতিরবিজ্ঞানী ফ্ল্যামস্টিড এর সহকারী হিসাবে অক্সফোর্ড এবং শ্রীনউইচে কাজ করতে থাকেন। ১৬৭৫ সালে এক গবেষণাপত্র ফ্র্যামস্টিড (Flamsteed) লিখেছিলেন:

‘’ Edmond Halley, a talented young man of Oxford, was present at these observations and assisted carefully with many of them’’



১৬৭৬ সালের ২১ আগস্ট তিনি চন্দ্রের আড়ালে মঙ্গল গ্রহের লুক্কায়িত হওয়ার ঘটনা নিয়ে গবেষণাপত্র প্রকাশ করে রয়েল সোসাইটির  Philosophical Transactions of the Royal Society’  পত্রিকাতে। তার পড়াশোনার কী হল জানা যায় নি। তবে সম্ভবতঃ ১৬৭৬ সালেই পড়াশুনা ছেড়ে দিয়ে তিনি সেন্ট হেলেনা দ্বীপে চলে যান ওই বছরের নভেম্বর মাসে। ১৬৭৫ সালে গ্রীনউইচের মান্‌ মন্দির প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর ফ্ল্যামস্টিড উত্তর গোলার্ধের নক্ষত্র গুলির একটা মানচিত্র আঁকার কাজে লেগে পড়েন। হ্যালি সিদ্ধান্ত নিলেন, তিনি সেন্ট হেলেনা থেকে দক্ষিণ গোলার্ধের নক্ষত্রগুলো মনোচীটড় আঁকবেন। এ ব্যাপারে তাকে আর্থিক সাহায্য দেন তার বাবা এবং রাজা দ্বিতীয় চার্লস। এ ছাড়া রয়েল সোসাইটির প্রেসিডেন্ট ব্রাউষ্কার এবং রাজকীয় মান মন্দির যার উৎসাহে প্রতিষ্ঠিত হয় সেই জেনাস মুরে- এরাও হ্যালীকে সেন্ট হেলেনায় কাজ করতে সাহাজ্য করেন।

হেলেনার আকাশ প্রায় পরিষ্কার থাকে না। ফলে, হ্যালীর নক্ষত্র পর্যবেক্ষণ ওখানে প্রায়শঃই ব্যাহত হতো। তবু এ দ্বীপে ১৮ মাস অবস্থানের পর হ্যালী দক্ষিণ গোলার্ধের ৩৪১ টি নক্ষত্রের তালিকা বানান। ১৬৭৮ সালে তিনি ফিরে আসেন ইংল্যান্ডে। এ বছরই ৩ রা ডিসেম্বর, তিনি অক্সফোর্ড থেকে মাতক হন পরীক্ষা না দিয়েই। রাজা দ্বিতীয় চার্লস তাকে বিনা পরীক্ষায় এই ডিগ্রি দেওয়ার ব্যবস্থা করে দেন। তার বয়স তখন ২২ বছর মাত্র। ওই বছরই তিনি রয়েল সোসাইটির সদস্য নির্বাচিত হন। তিনি এখনও অবধি রয়েল সোসাইটির সবচেয়ে কম বয়সেরসদস্যদের মধ্যে রয়েছেন।

 

ধূমকেতু নিয়ে অবৈজ্ঞানিক ধারণাগুলির পরিবর্তন ঘটিয়ে হ্যালীই প্রথম ঘোষণা করেন, ধুমকেতৃদের দেখে ভয় পাওয়ার কোনও কারণই নেই। ওরাও আমদের সৌরজগতের এক একজন বাসিন্দা। ওদের মুন্ডগুলি অকিক্ষুদ্র ধুলিকণা থেকে বৃহত্তম শিলাখন্ড নিয়ে গঠিত। এদের পচ্ছুগুলিতে হালকা নীহারের আবরন। সেই নীহারের উপাদানগুলি হচ্ছে জলীয় বাষ্প, মিথেন, আযামোনিয়া গাস। সূর্যের কাছাকাছি এলে সূর্যরশ্মির চাপে নীহার সৃষ্টি করে এই পচ্ছু। অর্থাৎ আশ্চর্যজনক এই জ্যোতিষ্কগুলি কোন অমঙ্গলের সংকেত বহন করে না। ওই সময় সবাই মনে করত, এগুলি অমঙ্গলের পূর্বাভাস বহন করে আনে বহির্বিশ্ব থেকে। তবে সে সময় হ্যালীর কথা কেউ বিশ্বাস করে নি। কিন্তু হ্যালী ধূমকেতুদের উপর তার গবেষণা বন্ধ করেন নি। কিছুদিন পরে এক দীর্ঘ পুচ্ছ সুন্দর ধূমকেতু দেখা গেল ইংল্যান্ডের আকাশে। হ্যালী গবেষণা করে জানালেন, এই ধূমকেতুটিকে আবার দেখা যাবে ৭৫ কিংবা ৭৬ বছর পরে পৃথিবীর আকাশে। তখন সে কথা কেউ বিশ্বাস করে নি। কিন্তু ৭৫ বছর পর সত্যি সত্যি তা দেখা গেল।সেদিন মানুষ খুশি হল। ধুমকেতু নিয়ে কুসংস্কার দূরীভূত হল মানুষের মন থেকে। জ্যোতিরবিজ্ঞানীরা ওই ধুমকেতুটির নাম রাখলেন 'হ্যালীর ধুমকেতু'। তখন অবশ্য হ্যালী বেঁচে ছিলেন না।

 

হ্যালী ওই ধুমকেতুটিকে নিরীক্ষণ করেছিলেন ১৬৮০ খ্রিস্টাব্দে। ওকে শেষ দেখা গেছে ১৯৮৬ সালে। তার আগে ১৯১০ সালেও ওকে দেখা গিয়েছিল। হ্যালীর ধূমকেতুর মধ্য দিয়ে তিনি অমর হয়ে আছেন। ১৬৮৪ সালের ২৪শে জানুয়ারী, এই ধূমকেতুর উপর তিনি যে সব গবেষণা করেছিলেন, তার ফলাফলগুলি তিনি পেশ করেন রয়েল সোসাইটির সভায়। কেপলারের তৃতীয় অর্থাৎ তার 'বিষমবগীয়' (Inverse Squrare Law) গ্রহদের উপবৃত্তাকার কক্ষপথের কথা বলে। কিন্তু হ্যালী এ সম্পর্কে কোনও প্রমাণ হাজির করতে পারলেন না তার ওই গবেষণাগুলির ফলাফল থেকে। ১৬৮২ সাল থেকেই তার ওই গবেষণার শুরু। কিন্তু সমস্যার সমাধান হচ্ছিল না কিছুতেই। ১৬৮৪ সালের আগস্ট মাসে হ্যালী কেমব্রিজ গিয়ে দেখা করলেন নিউটনের সাথে। নিউটনের সঙ্গে আলোচনা করেই হ্যালী জানালেন যে, নিউটন অনেক আগেই 'বিষমবরগঁয়' আকর্ষণের [Inverse Squrare Attraction] সঙ্গে উপবৃত্তাকার কক্ষপথের সম্পর্ক প্রমাণ করে ফেলেছেন। হ্যালী অত্যন্ত খুশি এবং চমৎকৃত হলেন। যে সমস্যার সমাধান হ্যালী এবং তার সহকর্মীরা করতে পারছিলেন না, তা নিউটন প্রায় নিখুতভাবে বেশ কাধে তুলে নিলেন। হ্যালীই তার পয়সা দিয়ে নিউটনের প্রিন্সিপিয়া'[Principia] ছাপিয়ে প্রকাশের ব্যবস্থা করলেন। ১৬৮৭ খ্রিস্টাব্দের জুলাই মাসে 'প্রিন্সিপিয়া' ছেপে বের হল। এ সম্পর্কে চ্যাপম্যান[Chapman] লিখেছেনঃ

‘‘ Halley…. Had the genius to recognize the even greater mathematical genius of Newton,to urge him to write the Principia Mathmatica, and then pay for the costs of publication out of his own pocket because the Royal Society was currectly broken….’’

১৮৮৮ খ্রিস্টাব্দে গ্রেইশার (Glaisher) এক বকৃতৃতায় বলেছিলেন, ‘‘…. But for Halley the Principia would not have existed …. He paid all the expenses, he corrected proofs,he laid aside his own work in order to the utmost the printing. All his letters show the most intense devotion to the work.’’

নিউটন স্বীকার করেছেন হ্যালীর খণ। হ্যালীর প্রায় ১৪ বছরের বড় ছিলেন নিউটন। বয়সের এই পার্থক্য সত্বেও নিউটনের সঙ্গে গভীর বন্ধুত্ব হয়েছিল হ্যালীর। হ্যালীর অন্যান্য আবিষ্কারগুলির মধ্যে নক্ষত্রের গতি নিরূপণ ও চন্দ্রের মধ্যগতির ত্বরণ নির্ণয় এছাড়া তিনি একটি বিশেষ পদ্ধতি আবিষ্কার করেন যার সাহায্যে সূর্য ও অন্যান্য নক্ষত্রের গতি নির্ণয় করা হতো। বিংশ শতাব্দী আরন্তের আগে তার এই পদ্ধতিই অনুসরণ করতেন জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা সূর্য ও নক্ষত্রের গতি নির্ণয়ে।

উন্নততর পদ্ধাতি আবিষ্কার হওয়ায় হ্যালীর পদ্ধতির ব্যবহার কমে যায়। তবে হ্যালীর এই পদ্ধতি যে একেবারে পরিত্যক্ত হয়েছে, এমন নয়। হ্যালী পুরাতত্ত্ব, ভূ-পদার্থবিজ্ঞান, জ্যোতিরবিজ্ঞানের উপরও গবেষণা করেন। তিনি সারাজীবন কেবল গবেষণাই করে গেছেন এবং তার ফল হয়েছে অত্যন্ত সুদূরপ্রাসারী। পুথিবীর সেরা জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের মধ্যে অন্যতম হলেন এডমন্ড হ্যালী ১৭৪২ খ্রিষ্টাব্দের ১৪ জানুয়ারী লন্ডনের গ্রীনউইচে দেহত্যাগ করেন।


লিখেছেনঃ

আবু সায়েম তাসনিম

গাংনী প্রি-ক্যাডেট এন্ড হাইস্কুল


1 comment:

Theme images by dino4. Powered by Blogger.